পশ্চিমবঙ্গে শুরু হলো ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন কর্মসূচি ২০২৬ (Special Intensive Revision of Electoral Roll 2026)

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now

প্রতিটি নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার হলো ভোটাধিকার। ভারতের সংবিধানে এই অধিকার সুরক্ষিত করা হয়েছে সংবিধানের ৩২৬ নম্বর ধারায়।
এই ভোটাধিকার ব্যবহার করতে হলে, আপনার নাম অবশ্যই ভোটার তালিকায় থাকতে হবে।
এই কারণেই ভারতের নির্বাচন কমিশন প্রতি বছর ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন কর্মসূচি চালায়, যাতে নতুন ভোটারদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা যায়, পুরনোদের নাম আপডেট করা যায়, এবং ভুল তথ্য সংশোধন করা সম্ভব হয়।

২০২৫ সালের শেষ থেকে শুরু হচ্ছে Special Intensive Revision of Electoral Roll 2026 – অর্থাৎ, ২০২৬ সালের নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকা সম্পূর্ণভাবে হালনাগাদ করা হবে।


এই কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের (CEO West Bengal) পক্ষ থেকে এই কর্মসূচি চালু করা হয়েছে।
এর মূল লক্ষ্য হলো—

  1. ✅ রাজ্যের প্রতিটি নাগরিকের নাম ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা।
  2. ✅ যেসব নাম বা তথ্য ভুল আছে, তা সংশোধন করা।
  3. ✅ যাঁরা মারা গেছেন বা স্থান পরিবর্তন করেছেন, তাঁদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া।
  4. ✅ নতুন ১৮ বছর বয়স পূর্ণ করা যুব-যুবতীদের নাম যুক্ত করা।

সংবিধানের ৩২৬ ধারা অনুযায়ী নিয়ম

সংবিধানের এই ধারায় বলা হয়েছে—

  • যে কোনো ভারতীয় নাগরিক যার বয়স ১৮ বছর বা তার বেশি, সে ভোট দিতে পারে।
  • ভোটার তালিকায় নাম যুক্ত হওয়ার জন্য নাগরিককে নিজের এলাকা অনুযায়ী আবেদন করতে হবে।
  • কেউ যদি অন্য এলাকায় বাস করে বা আইনত অযোগ্য হয়, তার নাম তালিকায় থাকবে না।

গুরুত্বপূর্ণ তারিখসমূহ (২০২৬ সালের ভোটার তালিকার জন্য)

কার্যক্রমতারিখ
বাড়ি-বাড়ি গণনা পর্ব৪ঠা নভেম্বর থেকে ৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫
খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ৯ই ডিসেম্বর, ২০২৫
দাবি ও আপত্তি জানানোর সময়সীমা৯ই ডিসেম্বর, ২০২৫ থেকে ৮ই জানুয়ারি, ২০২৬
আবেদন যাচাই (গ্রহণ ও বাতিল প্রক্রিয়া)৯ই জানুয়ারি থেকে ২৪শে জানুয়ারি, ২০২৬
চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৬

আপনাকে কী করতে হবে?

এই সময়সীমার মধ্যে প্রত্যেক নাগরিকের উচিত নিচের কাজগুলো করা:

  1. 🔍 নিজের নাম তালিকায় আছে কি না তা যাচাই করা।
    👉 এটি করা যাবে অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে গিয়ে – https://ceowestbengal.wb.gov.in
  2. ✍️ ভুল নাম, বয়স, ঠিকানা বা ছবি থাকলে তা সংশোধন করা।
  3. 🧑‍🤝‍🧑 যদি নতুন ভোটার হন (১৮ বছর পূর্ণ), তবে নতুন করে আবেদন করা।
  4. যদি পরিবারে কেউ প্রয়াত হয়ে থাকেন, তাঁর নাম মুছে দেওয়ার জন্য আবেদন করা।

BLO এর ভূমিকা

BLO মানে Booth Level Officer, যিনি আপনার ভোটার তালিকা সম্পর্কিত যাবতীয় কাজের দায়িত্বে আছেন।
প্রতিটি বুথে একজন BLO থাকেন। তাঁর কাজ হলো—

BLO কী করেন:

  1. বাড়ি-বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন।
    ভোটারদের নাম, ঠিকানা, বয়স, লিঙ্গ ইত্যাদি যাচাই করেন।
  2. নতুন ভোটারদের নাম যুক্ত করেন।
    যাদের বয়স ১৮ বছর বা তার বেশি হয়েছে, তাঁদের নাম ভোটার তালিকায় তোলেন (Form 6 পূরণ করে)।
  3. পুরনো তথ্য সংশোধন করেন।
    যদি কারও নাম, ঠিকানা বা বয়সে ভুল থাকে, BLO সেটি সংশোধনের ফর্ম নেন (Form 8)।
  4. অপ্রয়োজনীয় নাম মুছে দেন।
    প্রয়াত বা অন্যত্র চলে যাওয়া ভোটারদের নাম মুছে দেন (Form 7)।
  5. নতুন ভোটার আইডি কার্ড বিতরণ করেন।
    যখন নতুন EPIC কার্ড তৈরি হয়, BLO অনেক সময় নিজে গিয়ে ভোটারদের হাতে কার্ড তুলে দেন।
  6. ভোটার তালিকা আপডেট রাখেন।
    BLO-এর দায়িত্ব হলো বুথের ভোটার তালিকা সবসময় হালনাগাদ রাখা।

অনলাইনে কীভাবে আবেদন করবেন?

অনলাইন আবেদন করা এখন খুবই সহজ। আপনি নিচের দুইটি ওয়েবসাইট বা অ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন:

  1. 🔹 CEO West Bengal Official Website:
    👉 https://ceowestbengal.wb.gov.in
  2. 🔹 Election Commission of India’s Portal (ECI Net Service):
    👉 https://voters.eci.gov.in

📱 এছাড়াও আপনি Voter Helpline App ডাউনলোড করে মোবাইল থেকেই আবেদন করতে পারেন।


আগে থেকে যাদের নাম ভোটার তালিকায় আছে, তাদের কী কী জমা করতে হবে?

অনেকেই ভাবছেন — “আমার তো আগের থেকেই ভোটার তালিকায় নাম আছে, তাহলে আবার কী নথি দিতে হবে?”
কমিশন এর নতুন নিয়ম অনুযায়ী, আগে থেকেই যাদের নাম ভোটার তালিকায় আছে, তাদের আলাদা করে ১১টি নথি দিতে হবে না, যদি আপনার নাম ২০০২ সালের ভোটার লিস্টে থাকে

তবে যাদের নাম ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নেই বা নতুন করে যাচাই করতে হবে, তাদের জন্য কমিশন ১১টি নথির মধ্যে যেকোনো একটি জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। নিচে সহজভাবে দেওয়া হলো সেই নথিগুলির তালিকা ও তাদের অর্থ 👇

🧾 নথির নাম📖 বর্ণনা
জন্ম সনদপত্র (Birth Certificate)সরকার অনুমোদিত জন্ম রেজিস্ট্রার অফিস থেকে প্রাপ্ত আপনার জন্মের সরকারি প্রমাণপত্র।
পাসপোর্ট (Passport)কেন্দ্র সরকারের দেওয়া আন্তর্জাতিক পরিচয়পত্র, যা নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবেও ধরা হয়।
মাধ্যমিক বা তার উপরের কোনো শিক্ষাগত সনদপত্রমাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বা কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পরীক্ষার সনদপত্রও গ্রহণযোগ্য প্রমাণ।
রাষ্ট্র বা কেন্দ্র সরকারের অনুমোদিত বাসস্থানের শংসাপত্রসরকারি আবাসন দপ্তর থেকে প্রাপ্ত বা কোনো সরকারি প্রকল্পে বাসস্থানের অনুমোদনের নথি।
ফরেস্ট রাইট সার্টিফিকেট (Forest Right Certificate)বনাঞ্চলে বসবাসকারী ব্যক্তিদের জমির অধিকার প্রমাণপত্র।
জাতীয় শংসাপত্র (Nationality Certificate)স্থানীয় প্রশাসন বা আদালত কর্তৃক প্রদত্ত নাগরিকত্বের সরকারি প্রমাণ।
নাগরিক বা পারিবারিক রেজিস্টার (Family Register)পঞ্চায়েত বা পৌরসভার কাছে থাকা নাগরিক রেকর্ড, যেখানে পরিবারের নাম নথিভুক্ত থাকে।
জমি বা বাড়ির দলিল (Land/House Deed)জমি বা বাড়ি ক্রয়ের বৈধ দলিল যা প্রমাণ করে আপনি ওই এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।
ব্যাংক, পোস্ট অফিস বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের পুরনো নথি (Before July 1987)১৯৮৭ সালের জুলাই মাসের আগে ব্যাংক বা সরকারি দপ্তরে জমা দেওয়া কোনো প্রমাণপত্রও গ্রহণযোগ্য।
সরকারি চাকরির প্রমাণপত্রকেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের অধীনে কর্মরতদের অফিসিয়াল চাকরির রেকর্ড।
পেনশন প্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীর প্রমাণপত্রপেনশন পাওয়া সরকারি কর্মচারীর প্রমাণপত্রও বৈধ হিসেবে ধরা হবে।

কিন্তু যদি আমার নাম ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় থাকে?

👉 আপনার জন্য সুখবর!
যদি আপনার নাম ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় (Voter List 2002) আগে থেকেই থাকে, তাহলে উপরের ১১টি নথির একটিও জমা দিতে হবে না

সেক্ষেত্রে শুধু আপনাকে নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করতে হবে 👇

1️⃣ অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে যান – https://ceowestbengal.wb.gov.in
2️⃣ সেখানে গিয়ে আপনার জেলা ও বিধানসভা এলাকা (AC) নির্বাচন করুন।
3️⃣ এরপর আপনার বুথের Final Roll বা ২০০২ সালের ভোটার লিস্ট ডাউনলোড করুন।
4️⃣ এই লিস্টের মধ্যে আপনার নাম খুঁজে বের করে একটি প্রিন্ট কপি নিয়ে জমা দিন।

এতেই কাজ শেষ ✅
আর কোনো অতিরিক্ত নথি লাগবে না।


অনলাইনে আবেদন করার ধাপসমূহ

  1. প্রথমে https://voters.eci.gov.in ওয়েবসাইটে যান।
  2. “Login/Register” বাটনে ক্লিক করুন।
  3. নতুন ভোটার হলে “New Voter Registration (Form 6)” নির্বাচন করুন।
  4. নাম, বয়স, ঠিকানা, লিঙ্গ, মোবাইল নম্বর, ইমেল ইত্যাদি তথ্য দিন।
  5. প্রয়োজনীয় নথি আপলোড করুন (যেমন: আধার কার্ড, জন্ম সনদ বা অন্য প্রমাণ)।
  6. ফর্ম সাবমিট করুন এবং রেফারেন্স আইডি সংরক্ষণ করুন।
  7. কয়েকদিনের মধ্যে আপনার আবেদন যাচাই করা হবে।
  8. আবেদন গৃহীত হলে আপনার নাম ভোটার তালিকায় যুক্ত হবে।

কোন কোন নথি লাগবে?

নথির নামউদ্দেশ্য
✅ আধার কার্ডপরিচয় প্রমাণ
✅ জন্ম সনদ / স্কুলের সার্টিফিকেটবয়স প্রমাণ
✅ বিদ্যুৎ বিল / রেশন কার্ডঠিকানা প্রমাণ
✅ পাসপোর্ট সাইজ ছবিআবেদনপত্রে ব্যবহারের জন্য

বাড়ি-বাড়ি গণনা পর্বে কী হবে?

৪ঠা নভেম্বর থেকে ৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ পর্যন্ত বাড়ি-বাড়ি গণনা চলবে।
এই সময় ব্লক লেভেল অফিসার (BLO) আপনার বাড়িতে এসে তথ্য সংগ্রহ করবেন।

👉 আপনাকে আপনার পরিবারের সদস্যদের নাম, বয়স, ঠিকানা ও নাগরিকত্ব সংক্রান্ত তথ্য দিতে হবে।
👉 BLO ফর্ম পূরণ করে তা আপনার স্বাক্ষরসহ জমা নেবেন।
👉 সব তথ্য সঠিক আছে কি না তা যাচাই করা আপনার দায়িত্বও বটে।


খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের পর করণীয়

৯ই ডিসেম্বর, ২০২৫ তারিখে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশিত হবে।
এই সময় আপনি নিচের কাজগুলো করতে পারবেন:

  • নাম বা তথ্য ভুল থাকলে সংশোধনের আবেদন (Form 8) দিন।
  • নতুন নাম যোগ করতে চাইলে Form 6 ব্যবহার করুন।
  • প্রয়াত বা স্থান পরিবর্তিত ভোটারদের নাম মুছে দিতে Form 7 দিন।

এই সব ফর্ম অনলাইনে পাওয়া যাবে voters.eci.gov.in এ।


দাবি ও আপত্তির সময়সীমা

এই সময়সীমা ৯ই ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে ৮ই জানুয়ারি ২০২৬ পর্যন্ত চলবে।
এরপর যাচাই-বাছাই করে আবেদন অনুমোদন বা বাতিল করা হবে।


চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ

সব তথ্য যাচাই ও অনুমোদনের পর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে ৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৬ তারিখে।
এই তালিকাই ২০২৬ সালের নির্বাচনে ব্যবহৃত হবে।

আপনি চাইলে এই চূড়ান্ত তালিকা অনলাইনে PDF আকারে ডাউনলোড করতে পারবেন।


ভোটার হেল্পলাইন নম্বর

আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে সরাসরি কল করুন
📞 ১৯৫০ (Voter Helpline Number)
এই নম্বরটি ফ্রি, এবং সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে।


বিশেষ কিছু পরামর্শ

  • আবেদন করার আগে সমস্ত নথি স্ক্যান করে রাখুন।
  • একাধিকবার আবেদন করবেন না, তাতে বিভ্রান্তি হতে পারে।
  • BLO আপনার সাথে যোগাযোগ করলে তথ্য সঠিকভাবে দিন।
  • ভোটার তালিকা প্রকাশের দিন নিজের নাম অবশ্যই যাচাই করুন।

উপসংহার

ভোটাধিকার হলো আমাদের গণতন্ত্রের প্রাণ।
এই Special Intensive Revision of Electoral Roll 2026 কর্মসূচি আপনাকে সেই অধিকার সঠিকভাবে ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়।
তাই সময় নষ্ট না করে এখনই নিজের নাম, বয়স, ঠিকানা যাচাই করুন।
যদি এখনও নাম না থাকে, তাহলে অনলাইনে আবেদন করুন এবং ২০২৬ সালের নির্বাচনে গর্বের সঙ্গে ভোট দিন।

🗳️ মনে রাখবেন —
👉 “ভোট আপনার অধিকার, ভোট দিন সচেতন নাগরিক হিসেবে।”

Leave a comment